নরসিংদীর মনোহরদী পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৩ কাউন্সিলর প্রার্থী, সাংবাদিক ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠেছে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আমিনুর রশিদ সুজনের সমর্থকদের বিরুদ্ধে। তবে মেয়র সুজন অভিযোগ করেছে, প্রতিপক্ষের হামলায় তার দুই ভাইসহ কমপক্ষে ১২ জন আহত হয়েছে। বুধবার রাত ১১টার দিকে মনোহরদী হিন্দুপাড়াসহ পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে এ সকল হামলার ঘটনা ঘটেছে।
এ সময় মেয়র আমিনুর রশিদ সুজন শতশত নেতাকর্মী লাঠিশোটা নিয়ে মনোহরদী বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান নিলে গোটা পৌর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব ঘটনাস্থলে এলে মেয়রকে বাসস্ট্যান্ড থেকে সরিয়ে দিলে ভোর ৪টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ ঘটনায় পুরো এলাকায় থম থমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
এদিকে সাংবাদিক সুমন বর্মণের বাড়িতে হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন, নরসিংদী প্রেসক্নাব, নরসিংদী জেলা টেলিভিশন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, মনোহরদী সাংবাদিক ফোরাম, মনোহরদী রিপোর্টাস ক্লাবসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার সাংবাদিকরা। তাঁরা হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবী জানান।
ক্ষতিগ্রস্থরা ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জানায়, পৌরসভা নির্বাচনে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের নিকট বর্তমান মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক আমিনুর রশিদ সুজন, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি কফিল উদ্দিন, সাধারন সম্পাদক আবদুস সামাদ মোল্লা জাদুর নাম প্রস্তাব করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী তালিকার সকলে মনোনয়ন পত্র ক্রয় করার কথা থাকলেও রহস্যজনক কারনে মেয়র সুজন ছাড়া কেউ মনোনয়নপত্র ক্রয় করেনি। দলীয় সিদ্ধান্ত সিথিল করার পরও মেয়রের হুমকীর মুখে একাধিক প্রার্থী থাকা স্বত্বেও কেউ মনোনয়ন ক্রয় করতে পারেনি। মেয়র সুজন দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার পর স্থানীয় এমপি শিল্পমন্ত্রী এ্যাডভোকেট নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের নির্দেশে আওয়ামী লীগ ও সকল অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নৌকা প্রতিককে বিজয়ী করার জন্য কাজ করছে।
কিন্তু পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যেই বর্তমানে ৬টিতেই বিএনপির কাউন্সিলর। যাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই মেয়র সুজনের সখ্যতা রয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ৪টি ওয়ার্ডে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের প্রার্থী দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রীর ছেলে মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ সাদী। যা নিয়ে মেয়র সুজনের সঙ্গে মন্ত্রীপুত্র সাদীর মতবিরোধ দেখা দেয়।
বুধবার রাত ৮টায় মনোহরদী হিন্দুপাড়া সার্বজনীন দুর্গাবাড়িতে মেয়র আমিনুর রশিদ সুজনের সর্বশেষ উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট ফজলুল হক, সাধারন সম্পাদক বাবু প্রিয়াশীষ রায়, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক শিল্পমন্ত্রীর ছোট ভাই নজরুল মজিদ মাহমুদ স্বপন ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যকরী সদস্য মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ সাদীসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় কাউন্সিল প্রার্থীরা তাদের সমর্থকদের নিয়ে যোগ দেয়।
রাত ১১টার দিকে সভা শেষে ফেরার পথে কাউন্সিলর প্রার্থী হারুন মাঝি ও খোকন রায়ের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে হারুন মাঝির পক্ষে অবস্থান নেয় মেয়র সুজনের সমর্থকরা। আর খোকন রায়ের পক্ষে অবস্থান নেয় সাদীর সমর্থকরা। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে মেয়রের দুই ভাইসহ কমপক্ষে ১২জন আহত হয়। এ সময় উভয় পক্ষের ৫টি মোটর সাইকেল ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট ফজলুল হকের গাড়ি ভাংচুর করা হয়।
এই খবর ছড়িয়ে পড়লে মেয়র সুজনের নেতৃত্বে শতশত সমর্থক মনোহরদী বাসস্ট্যান্ডে জড়ো হয়। সেখান থেকে মেয়রের সমর্থকরা প্রথমে মনোহরদী হিন্দুপাড়ার মনোহরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং নরসিংদী জেলা টেলিভিশন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক সাংবাদিক সুমন বর্মণ, কাউন্সিলর প্রার্থী পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক খোকন রায়, সুকোমল সাহার বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে। হামলা চালানো হয় সাংবাদিক সুমন বমর্ণের ৩টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক মিহির রায়ের বাড়ির দোকানে। পরে একে একে চকপাড়া এলাকায় ৫নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শরীফ রায়হান ও তাঁর সমর্থকদের বাড়িঘর ও অফিসে, ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোতাহার হোসেনের অফিস ও উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শফিকুল ইসলামের মডার্ন ডায়নোষ্টিক সেন্টারে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট করা হয় বলে অভিযোগ ওঠেছে।
হামলায় আহতদের মধ্যে চন্দনবাড়ি এলাকার মেয়র সুজনের বড় ভাই মামুনুর রশিদ (৩৫), ছোট ভাই হাসানুর রশিদ তন্ময় (২৫), ইমতিয়াজ মান্নান (৩০), আল সাঈদী সাম্মী (৩২) শফিকুল আলম (৪৫), সোহেল আকন্দ (২৬) মাঝিপাড়া এলাকার মাসুম হাসান শুভ (৩০), লেবুতলা এলাকার নজরুল ইসলামকে (৪০) মনোহরদী উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে মামুনুর রশিদ ও শফিকুল আলমকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
জানতে চাইলে ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী খোকন রায় বলেন, মেয়র সুজন ও কাউন্সিলর প্রার্থী হারুন মাঝি আমার বাড়ি ও সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা চালিয়েছে। তারা পরিকল্পিতভাবে এই বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে যাতে ভোটের পরিবেশ নষ্ট হয়।
মনোহরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াশীষ রায় বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরে সাংবাদিক ও হিন্দু বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা দুঃখজনক। আমরা এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।
মনোহরদী পৌরসভার আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আমিনুর রশিদ সুজন বলেন, হিন্দুপাড়ায় আমি আমার নির্বাচনী উঠান বৈঠক শেষ করে চলে যাওয়ার সময় আমার উপর অতর্কিত ভাবে প্রতিপক্ষরা হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আমাকে আঘাত করার সময় আমার দুই ভাই আমাকে বাঁচাতে গেলে তারা গুরুতর আহত হয়েছে। এ ঘটনায় আমার ১২জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছে। একই সাথে আমার এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে। হামলার ঘটনায় ভাংচুরের বিষয়ে তিনি অস্বীকার করেন।
কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যনিবার্হী সদস্য মঞ্জুরুল মজিদ মাহমুদ সাদী বলেন , মেয়র নিজের সুবিধার জন্য বিএনপির কাউন্সিলর বিজয়ী করতে চায়। যেহেতু আমি দলীয় কাউন্সিলরের পক্ষে তাই এটাকে ইস্যু করে বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থক ও মেয়রের সমর্থকরা নৌকার
উঠান বৈঠক শেষে ফেরার পথে আমার উপর হামলা চালায়। পুলিশ আমাকে উদ্ধার করেছে। তারা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলা চালিয়েছে। আমরা এই ঘটনার বিচার চাই।
মনোহরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটেছে। থানায় কেউ কোন অভিযোগ করেনি। বর্তমানে পরিস্থিতিতে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কোথাও আইনশৃঙ্খলার যাতে অবনতি না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।