তিতুমীর কলেজ প্রতিনিধি: পারিপার্শ্বিক নানা কারণে তরুণ প্রজন্ম মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে অনলাইন আসক্তিতেও জড়িয়ে পড়ছেন তারা। এতে তাদের সৃজনশীলতা ও সামাজিক মূল্যবোধে ভয়াবহ ধস নামছে। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অপচয় হয়ে যাওয়ার এক পর্যায়ে ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন তারা।
শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘আসক্তির ভয়াবহতা ও ক্যারিয়ার নির্বাচনে বিভ্রান্তি: সমাধান যে পথে’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মশালায় এসব কথা বলেন বিশিষ্টজনেরা।
এ সময় ফেসবুক ও মাদকের আসক্তি পরিত্যাগ করে তরুণ প্রজন্মকে ক্যারিয়ার গঠনের সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনায় মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল হক বলেন, মাদক গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। মাদকের ভয়াবহ বিস্তারের কারণে সামাজিক আচরণে নৈতিক স্খলন ঘটছে। এটি প্রতিরোধ করতে তরুণদেরকে মাদকাসক্ত বন্ধুর প্রথম আহ্বানকেই প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
আগে ক্যারিয়ার গঠনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় ডাক্তার, ইঞ্জিয়ার, ওকালতি বা বিসিএস দিয়ে বড় সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার সুযোগ ছিল। বর্তমানে এ ধরনের সীমাবদ্ধতা নেই, এর পরিধি অভাবনীয়ভাবে বেড়েছে। সুযোগ-সুবিধা বাড়ায় প্রান্তিকের যে কেউ ইচ্ছা করলেই দেশের বাইরে পড়তে যেতে পারছেন। তবে হতাশার কথা হলো, বর্তমানে এসব মেধা বাইরে থেকে আর দেশে ফিরছে না।’
তিনি বলেন, ‘একটা সময় তথ্য সংগ্রহের জন্য আমাদেরকে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, বাতিঘর, বায়তুল মোকাররম ঘুরতে হতো। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে তথ্য পাওয়া খুবই সহজ।’
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে মোবাইল আসক্তি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে বলে জানান অ্যাডভোকেট শাহ মনজুরুল হক। বলেন, ‘আমরা স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছি। দেখা গেল, ফোনে ক্লাস চালু রেখেই ফেসবুকে চলে যাচ্ছি। অথচ এখানেই কিন্তু আমাদের প্রয়োজনীয় জরুরি তথ্য পাওয়া যায়।’
এ সময় প্রযুক্তির সার্থক ও দায়িত্বশীল ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। বলেন, সফল হতে এসবের পাশাপাশি খাবার, ঘুম ও সামাজিক বন্ধনগুলো ঠিক রাখতে হবে।
অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী বক্তব্যে সাবেক শিক্ষা ও আইসিটি সচিব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর নজরুল ইসলাম খান বলেন, পারিপার্শ্বিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এটি তরুণদের উপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।
তাদের বিপথগামী হওয়া ঠেকাতে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতিবাচক বিষয় ছড়িয়ে দেওয়ার ওপর জোর দেন নজরুল ইসলাম খান। বলেন, ‘আমরা চাইলে এটি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবেই আমাদের সমাজ সুন্দর হবে। তরুণ প্রজন্মকে এই বিষণ্ণতা থেকে বের করে আনা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, পরিবারগুলো ছোট হয়ে যাওয়ায় একাকিত্ম বাড়ছে। ফলে ফেসবুকসহ নানা আসক্তি দেখা দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সন্তানদেরকে সংস্পর্শে রাখার পাশাপাশি তাদের সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে অভিভাবকদের পরামর্শ দেন তিনি।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘পশ্চিমাদের কাছ থেকে মদ পানসহ খারাপ অভ্যাসগুলো শিখলেও আমরা সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের বিষয়টি ধারণ করছি না। তিনি স্বাস্থ্যকর খাবার-দাবার থেকে শুরু করে সব কিছুতে ইতিবাচক হওয়ার হওয়ার আহ্বান জানান।
ক্যারিয়ার গঠনে এককেন্দ্রীক চিন্তা পরিহার করে বহুমুখী পরিকল্পনার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, অল্প সময়ে সাফল্য পেতে বছরের পর বছর বিসিএস পরীক্ষার পেছনে লেগে না থেকে নতুন নতুন পেশায় মনোযোগ দিতে হবে।
এ রকম গুরুত্বপূর্ণ আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান নজরুল ইসলাম খান।
অনুষ্ঠানে তামাকের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরেন একুশে পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও মাদক দ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রতিষ্ঠাতা বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী। তিনি বলেন, ধূমপানের জন্য চুল পড়া, স্ট্রোকসহ অসংখ্য রোগ দেখা দেয়।
ধূমপানের কারণে ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ধূমপায়ীর জীবন থেকে স্বস্তি বিদায় হয়ে যায়।
তিনি বলেন, জর্দা, গুলের কারণে মুখের ক্যান্সার হয়। এ ছাড়া পান ও সুপারীতে সেবনকারীও মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হন।
ধূমপানকে নাটের গুরু উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৯৮ ভাগ মাদকসেবীর সূচনা হয় ধূমপান দিয়ে।
অনুষ্ঠানে তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, মাদকাসক্ত শিক্ষার্থী মেডিকেলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে না। এমনকি মাদকাসক্ত ব্যক্তি সরকারি চাকরিতেও প্রবেশ করতে পারবেন না।
দেশে ই-সিগারেট সেবনের প্রবণতা বাড়ছে উল্লেখ করে ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, উন্নত বিশ্বে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ হয়েছে, ৫৭টি দেশে বন্ধের উদ্যোগ প্রায় চূড়ান্ত। বাংলাদেশেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিকন পয়েন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তহিদুল বাশার বলেন, তরুণরা নানা কারণে মাদকাসক্ত হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—কৌতূহল, বন্ধুবান্ধবের প্রলোভন, পারিবারিক সমস্যা, বেকারত্ব, হতাশা ও দুঃখবোধ, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা, প্রেমঘটিত কারণ ও সুষ্ঠু বিনোদনের অভাব।
মাদকাসক্তি থেকে তাদেরকে পুনর্বাসনে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাদক ব্যবসা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
এ সময় মাদক প্রতিরোধে সরকারের নানা পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি।ইন্টারনেট, মোবাইল আসক্তির কারণে যুব সম্প্রদায় পথহারা হয়ে যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন বিকন পয়েন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
দ্য বাংলাদেশ এন্টি ড্রাগ ফেডারেশনের সেক্রেটারি এশিয়ান টিভির প্ল্যানিং এডিটর রফিকুল ইসলাম রলির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান শিরিনা বিথি। এতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।
বিকেলে সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান। বিশেষ অতিথি ছিলেন দ্য বাংলাদেশ এন্টি-ড্রাগ ফেডারেশনের উপদেষ্টা ও সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের সহ-সভাপতি মো. মিজানুর রহমান মজুমদার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মজিবুর রহমান পাটোয়ারী প্রমুখ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও দ্য বাংলাদেশ এন্টি ড্রাগ ফেডারেশনের সভাপতি নুর মোহাম্মদ। দ্য বাংলাদেশ এন্টি ড্রাগ ফেডারেশনের উপদেষ্টা ও টুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ট্রিয়াব) সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ।
নরসিংদী মিরর/এফএ